মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা সংস্থা বোয়িংয়ের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার মডেলের উড়োজাহাজ পরিচালনা করতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে সমস্যায় পড়ছে বিভিন্ন এয়ারলাইনস।
মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা সংস্থা বোয়িংয়ের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার মডেলের উড়োজাহাজ পরিচালনা করতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে সমস্যায় পড়ছে বিভিন্ন এয়ারলাইনস। আকাশে থাকা অবস্থায় হঠাৎ উচ্চতা পড়ে যাওয়া, উইন্ডশিল্ডে ফাটলসহ নানা ধরনের কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ছে প্রায়ই। এ মডেলের উড়োজাহাজে বড় ধরনের নির্মাণ ত্রুটির অভিযোগ এখন বৈশ্বিক আকাশ পরিবহন খাতের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরেও রয়েছে ছয়টি ড্রিমলাইনার। এসব উড়োজাহাজে বিভিন্ন সময় দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের কারিগরি ত্রুটি। ২০২৪ সালে বিমানের বহরে থাকা ড্রিমলাইনার দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার সময় উইন্ডশিল্ডে ফাটলের দুটি ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া অন্তত দুই দফায় কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে, যার জন্য ফ্লাইটে বিলম্ব, এমনকি যাত্রা বাতিলও হয়েছে।
বোয়িংয়ের ড্রিমলাইনার বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা করে ২০১১ সালের ২৬ অক্টোবর। এর পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময় এ মডেলের উড়োজাহাজে নানা যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা সামনে এসেছে। ড্রিমলাইনারের নিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে বড় ধরনের আলোচনা তৈরি করে গত বছরের এপ্রিলে। বোয়িংয়ের সাবেক কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার স্যাম সালেহপৌর ওই সময় দাবি করেন, খরচ বাঁচাতে ৭৮৭ সিরিজের উড়োজাহাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ছাড় দিয়েছে বোয়িং।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আগস্টে আবার আলোচনায় আসে ড্রিমলাইনার। নিউজিল্যান্ডভিত্তিক আকাশ পরিবহন সংস্থা লাথাম এয়ারলাইনসের সিডনি থেকে অকল্যান্ডগামী একটি ফ্লাইট মাঝ আকাশে হঠাৎই উচ্চতা হারাতে শুরু করে। বড় দুর্ঘটনা না ঘটলেও হঠাৎ অনুভূমিক চলার কারণে ফ্লাইটের ৫০ যাত্রী আহত হন। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্য ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ১৫৮টি ড্রিমলাইনার ও বিশ্বজুড়ে থাকা ৭৩৭ উড়োজাহাজ পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেয়।
এর পরও ঘটেছে উড়োজাহাজটির মাঝ আকাশে হঠাৎ উচ্চতা হারানোর ঘটনা। গত ২৪ জানুয়ারি নাইজেরিয়ার লাগোস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনগামী ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে একই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এ ঘটনায় চারজন যাত্রী ও দুজন ক্রু গুরুতর আহত হন। সামান্য আহত হন আরো ২৭ যাত্রী ও পাঁচজন ক্রু।
হঠাৎ উচ্চতা হারানো ছাড়াও আকাশে থাকা অবস্থায় উইন্ডশিল্ডে ফাটলের ঘটনাও ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজে বেশি ঘটছে। সর্বশেষ ৯ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডসের রয়েল ডাচ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজের বাম দিকের মূল উইন্ডশিল্ডে ফাটল দেখা দেয়। এ ফাটল নিয়েই আমস্টারডাম থেকে কোস্টারিকাগামী ওই ফ্লাইটটি গন্তব্যে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ বিমানের বহরে বোয়িংয়ের ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ রয়েছে ছয়টি, যেগুলো যুক্ত হয়েছে ২০১৮-২০১৯ সালে। ২০২৪ সালে এ মডেলের উড়োজাহাজে উইন্ডশিল্ডে ফাটলের দুটি ঘটনা ঘটেছে।
২০ জানুয়ারি বিমানের ঢাকা-দাম্মাম ফ্লাইট পরিচালনা করা হয় বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ দিয়ে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর উড়োজাহাজটির উইন্ডশিল্পে ফাটল দেখা দেয়। ২ ঘণ্টা পর বিমানটি আবার ঢাকায় জরুরি অবতরণ করানো হয়।
আরেকটি ঘটনা ৮ সেপ্টেম্বরের। স্থানীয় সময় রাত ১২টা ৫ মিনিটে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিজি-০৩৪৮। গন্তব্য ছিল ঢাকা। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটি যখন ওমানের আকাশে, তখন ফ্রন্ট উইন্ডশিল্ডে ফাটল ধরা পড়ে। ঝুঁকি এড়াতে ফ্লাইটটি আবার দুবাই বিমানবন্দরে ফিরিয়ে নেয়া হয়। পরদিন উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ পাঠিয়ে ওই ফ্লাইটের ২৪৪ যাত্রীকে ঢাকায় আনা হয়।
শুধু উইন্ডশিল্ডে ফাটল নয়, গত বছর ফ্লাইট পরিচালনার সময় অন্তত দুটি যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছে বিমানের ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজে। এর মধ্যে গত ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে দুবাইগামী একটি ফ্লাইটে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। ত্রুটি সারিয়ে প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর ফ্লাইটটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে। ১৪ মে ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে সেটি ভারতের আকাশসীমা থেকে ফিরিয়ে আনা হয়।
নতুন উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হওয়ার পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে এ ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ার কথা নয় বলে জানিয়েছেন বিমানের একাধিক কর্মকর্তা। নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে এসব সমস্যা হতে পারে বলে ধারণা তাদের।
বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম বলেন, ‘এত ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়া মোটেও স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমরা বিষয়গুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি এবং উড়োজাহাজগুলোর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। ড্রিমলাইনারে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি শুধু আমাদের এখানে (বিমান) হচ্ছে এমনটা না। বিশ্বব্যাপী ড্রিমলাইনারে নানা ধরনের ত্রুটির কথা আমরা শুনছি। উইন্ডশিল্ডে ফাটলের ঘটনা বেশি ঘটছে। আমরা শুনেছি, ত্রুটি থাকা উইন্ডশিল্ড পুনঃস্থাপন করতে বোয়িংকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।’
শুধু ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ নয়, বিমানের বহরে থাকা বোয়িং ৭৩৭-৮, ৭৭৭-৩ ও ড্যাশ-৮ মডেলের উড়োজাহাজেও ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। সর্বশেষ গত বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টা ৫৩ মিনিটে ঢাকা থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া একটি ফ্লাইট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভারতের নাগপুরে জরুরি অবতরণ করে।
বিমান থেকে গতকাল পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিজি-৩৪৭ নম্বরের ওই ফ্লাইটটিতে ৩৯৫ জন যাত্রী ছিলেন। উড্ডয়নের প্রায় ২ ঘণ্টা পর একটি টেকনিক্যাল সিগন্যাল পান উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুবাই না গিয়ে ফ্লাইটটি ভারতের নাগপুরে জরুরি অবতরণ করে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৩৯ মিনিটে আরেকটি ফ্লাইট যাত্রীদের নিয়ে নাগপুর থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়।
যান্ত্রিক ত্রুটিতে ফ্লাইট বাতিল ও বিলম্বের কারণে বার বার বিঘ্নিত হচ্ছে বিমানের যাত্রীসেবা। এর প্রভাব পড়ছে সংস্থাটির অন টাইম পারফরম্যান্সে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিমানের ফ্লাইট ডিপারচারের ক্ষেত্রে বিমানের অন টাইম পারফরম্যান্স ছিল ৬৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ফ্লাইট অ্যারাইভালের ক্ষেত্রে এ হার আরো কম, ৬৬ শতাংশ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সম্প্রতি করা এক প্রতিবেদনে অন টাইম পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ার জন্য ১২টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রকৌশল বা কারিগরি কারণও রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
সামগ্রিকভাবে বিমানের কারিগরি ত্রুটি কমিয়ে আনা ও অন টাইম পারফরম্যান্স উন্নত করতে উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে আকাশ পরিবহন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘উড়োজাহাজের বয়স যত বাড়ে, যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ার প্রবণতা তত বেশি হয়। আমরা দেখেছি, বোয়িংয়ের উড়োজাহাজগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ প্রথম পাঁচ-সাত বছর ভালো সার্ভিস দেয়। তারপর এগুলো নষ্ট হতে শুরু করে।
এসব বিষয় মাথায় রেখেই বিমানের উচিত রক্ষণাবেক্ষণে আরো গুরুত্ব দেয়া। রক্ষণাবেক্ষণ দুর্বলতার কারণে যেন কোনো কারিগরি ত্রুটি তৈরি না হয়, সেদিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। পাশাপাশি বিমানের স্টোরে যেসব যন্ত্রাংশ রয়েছে, সেগুলোর মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্ধারিত ভারী মাত্রার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এর বাইরে নির্মাণজনিত কোনো সমস্যা যদি থাকে, তাহলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে উড়োজাহাজগুলো সব সময় ত্রুটিমুক্ত রাখতে হবে।’
এর ব্যত্যয় হলে বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি এড়ানো সম্ভব হবে না এবং যাত্রীসেবার মান দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাবে বলে মনে করেন তিনি।