বছরের ১০ মাসই লোকসানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স

বছরের ১০ মাসই লোকসানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

হজের দুই মাস ছাড়া বছরের বাকি ১০ মাস লোকসান গুনেছে বিমান। এরপর হজের দুই মাসের মুনাফার ভাগাভাগি নিয়ে বিমানজুড়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে।
উচ্চ ও মধ্যম লেভেলের অফিসারদের লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে- এ ঘোষণায় ফুঁসে উঠছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া (ক্যাজুয়াল) আড়াই হাজার কর্মচারী।
অব্যবস্থাপনায় চারটি ব্র্যান্ড নিউ বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজের অধিকাংশ মনিটর নষ্ট হয়ে পড়েছে। এদিকে ঘোষণা দিয়েও ক্যাজুয়াল শ্রমিকের চাকরি স্থায়ী না করার সিদ্ধান্তে আবারও অসন্তোষ শুরু হয়েছে।
এখন তারা আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীর্ঘদিন পর ৩৩ জন শিক্ষানবিস অফিসার নিয়োগ দিলেও তাদের পদায়ন করতে পারছে না ম্যানেজমেন্ট।
বাধ্য হয়ে তাদের বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে। প্রকৌশল ও পরিকল্পনা বিভাগে উচ্চ বেতনে দু’জন পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের পারফরম্যান্স নিয়ে হতাশ বিমান।
এমন জটিল অবস্থায় আজ বৃহস্পতিবার বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে পারে সাধারণ সভা। এরই মধ্যে দাবি উঠেছে বিমানকে গতিশীল করতে একটি পেশাদারি পরিচালনা পর্ষদ দরকার।
বিমান সূত্র জানায়, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ফ্লাইট বিলম্ব হচ্ছে। টাকার অভাবে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজের মনিটরও সারাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। ড্রিমলাইনার দিয়ে লন্ডনে সপ্তাহে ছয়টি ফ্লাইট অপারেট করার ঘোষণা দিয়ে মাত্র তিন দিনের মাথায় তা বাতিল করা হয়।
এদিকে মিসর থেকে ভাড়ায় আনা দুটি উড়োজাহাজ ভিয়েতনাম বিমানবন্দরে এক বছর ধরে পড়ে আছে। টাকার অভাবে উড়োজাহাজ দুটি মেরামত করা যাচ্ছে না। দুটি উড়োজাহাজের পাঁচটি ইঞ্জিন ঠিক করতে কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, পরিচালনা পর্ষদে বিমানের আয়-ব্যয়সহ সব ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
ভিয়েতনামে পড়ে থাকা দুটো বোয়িং কখন আনা সম্ভব হবে তা বলা মুশকিল। তবে শিগগিরই আনার চেষ্টা চলছে।
বিমানের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্য বিমানকে বাঁচাতে হলে বর্তমান পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিমানের টপ টু বটম ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথা যে কোনো সময় প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হতে পারে।
বিমানের হিসাব শাখা সূত্র জানায়, আর্থিক সংকট ও প্রকৌশল শাখার স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও অরাজকতার কারণে একের পর এক উড়োজাহাজ যান্ত্রিক ত্র“টিতে পড়ছে।
লিজ বাণিজ্যের কাছে জিম্মি হয়ে আছে প্রকৌশল শাখা। অপচয়, অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় ও পাইলটদের বিপুল অঙ্কের বেতন বৃদ্ধির কারণে হঠাৎ আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে বিমান।
হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের একমাত্র হজের দুই মাস ছাড়া বাকি ১০ মাস বিমান লোকসান গুনেছে।
ক্যাজুয়ালদের ফের হুমকি : দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মুখে বিমান কর্তৃপক্ষ মাসদুয়েক আগে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের সব দাবি মেনে চাকরি স্থায়ী করার ঘোষণা দেয়।
তবে এ সিদ্ধান্ত থেকে সম্প্রতি সরে এসেছে কর্তৃপক্ষ। আপাতত ১২ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরিরত চুক্তিভিত্তিকদের নিয়োগ স্থায়ী করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় আবারও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আড়াই হাজার ক্যাজুয়াল শ্রমিক-কর্মচারী।
বিমানের সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান বলেন, এ নতুন সিদ্ধান্তে আড়াই হাজার ক্যাজুয়াল শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৩০০ জনের চাকরি স্থায়ী হতে পারে।
তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্তে শ্রমিক-কর্মচারীরা চরম ক্ষুব্ধ হলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় আন্দোলন যাবে না। নির্বাচনের পর এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
এদিকে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের আহ্বায়ক হানিফ জানান, বিমান এমন নীতি গ্রহণ করেছে যাতে ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা বিভক্ত হয়ে যায়। শ্রমিকরা এখন আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবার জন্য সমান সুযোগ নীতিতেই এর ফয়সালা করতে হবে। না হলে ফের কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে : দীর্ঘদিন পর নিয়োগবিধি মেনে ৩৩ জন শিক্ষানবিস কর্মকর্তাকে (ট্রেইনি অফিসার) বিমান নিয়োগ দিয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণও শেষ হয়েছে।
কিন্তু তাদের যখনই বিভিন্ন শাখায় শূন্য পদের বিপরীতে পদায়ন করা শুরু হয় তখনই বাধা আসে সাধারণ কর্মচারীদের পক্ষ থেকে।
এ অবস্থায় বিমান বাধ্য হয় তাদের যোগদান থেকে বিরত রাখে। বাধ্য হয়ে বিএটিসিতে সংয্ক্তু করে বসিয়ে রেখে বেতন দেয়া হচ্ছে।
লন্ডনে বন্ধ ড্রিমলাইনার হংসবলাকার ফ্লাইট : অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে মাত্র তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ঢাকা-লন্ডন ড্রিমলাইনার হংসবলাকার ফ্লাইট। আগে ৭৭৭ দিয়ে লন্ডনে সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট অপারেট করা হতো।
সম্প্রতি বহরে নতুন উড়োজাহাজ হংসবলাকা যুক্ত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১০ ডিসেম্বর থেকে লন্ডনে সপ্তাহে ছয়টি ফ্লাইট অপারেট করা হবে।
হংসবলাকা দিয়ে প্রথম তিনটি ফ্লাইট সেভাবে অপারেট করা হয়। এরপর কোনো ঘোষণা ছাড়াই হংসবলাকা হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হয়।
অথচ ঢাকঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত জানানো হয়েছিল নতুন এ ঘোষণা।
এখন ড্রিমলাইনারের পরিবর্তে ৭৭৭ দিয়ে সপ্তাহে ছয়টি ফ্লাইট অপারেট করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে একদিকে বিমানের আর্থিক গচ্চার পাশাপাশি ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কেননা ইতিমধ্যে ড্রিমলাইনারের নামে বিক্রি করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক টিকিট। অনেকেই শুধু ড্রিমলাইনারে ওঠার আশায় টিকিট কিনেছেন।
এখন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্বে চড়তে হচ্ছে ৭৭৭ উড়োজাহাজে। এতে ২৭১ যাত্রীর ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ছয়টি ড্রিমলাইনারে ১৬২৬ জন যাত্রীকে পাঠাতে হচ্ছে ৪১৯ আসনের ৭৭৭ দিয়ে। এর সাপ্তাহিক পরিবহন ক্ষমতা ২৫১৪ জন।
এমন তুঘলকি ঘটনার জন্য কারা দায়ী জানতে চাইলে প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, লন্ডনে যাওয়ার মতো ড্রিমলাইনারের ককপিট ক্রু তৈরি করতে পারেনি বিমান।
সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ জটিলতা দেখা দিয়েছে। ড্রিমলাইনারের জন্য ককপিট ক্রু তৈরি নিয়ে ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের স্বেচ্ছারিতার কারণে এ সংকট।

মুজিব মাসুদ, যুগান্তর

 

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.