বিমানের নতুন উড়োজাহাজে হজ ফ্লাইট : খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি

2_271297মুজিব মাসুদ : বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স ৭০ কোটি টাকা মুনাফা করতে গিয়ে দু’শ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাবে গত হজ মৌসুমে এ লস দেয় বিমান। নিজস্ব নতুন এয়ার ক্রাফট দিয়ে হজ ফ্লাইট চালাতে গিয়ে এ অবস্থায় পড়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। এ পরিস্থিতিতে আগামী হজেও বিমান নিজেদের চারটি এয়ারক্রাফট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এতে লোকসানের পরিমাণ চারশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশংকা আছে। কোটি কোটি টাকা লিজ বাণিজ্যের আশায় এ ধরনের আত্মঘাতী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।

তবে বিমান পরিচালনা পর্যদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন বলেন অন্য কথা। তার মতে, হজ ফ্লাইট আর সাধারণ ফ্লাইটের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং হজ ফ্লাইটে উড়োজাহাজ বেশি সেইফ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের হজযাত্রীরা ইহরাম বেঁধে বিমানে ওঠেন। উড়োজাহাজে উঠার পর ওজু নষ্ট হওয়ার ভয়ে তারা বাথরুমেও যান না। ফ্লাইটের অধিকাংশ সময় তাদের দোয়া-কালাম, তসবিহ তেলাওয়াত, নামাজের মধ্যে সময় কাটাতে দেখা যায়। বেশিরভাগ হজযাত্রী খাওয়া-দাওয়াও করেন না। চুপচাপ বসে থাকেন। কাজেই উড়োজাহাজ নষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অপরদিকে সাইকেল নষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন প্রতিযোগিতার বাজারে সব এয়ারলাইন্স বোয়িং ৭৭৭-৩০০ দিয়ে এসব রুট পরিচালনা করে।

বিমানের পরিচালনা পর্যদের সদ্য সাবেক সদস্য আবুল কাসেম আহম্মেদ জানান, গত বছর নিজস্ব দুটি এয়ারক্রাফট দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করায় ২০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ক্ষতি ছিল দৃশ্যমান আবার কিছু ক্ষতি ছিল অদৃশ্য।
বিমানের পরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, উড়োজাহাজের অভ্যন্তরীণ নকশা, কার্পেট, টয়লেট, ভিডিও স্ক্রিন নষ্ট হয়ে ১২০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। অপরদিকে সাইকেল (ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ারের) নষ্ট হয়ে ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা। বিমান কর্তৃপক্ষ এ ক্ষতি এখন না বুঝলেও ডি চেক (হেভি ম্যানটেনেন্স) করার সময় কড়ায়গণ্ডায় মূল্য পরিশোধ করতে হবে। নতুন এয়ারক্রাফটগুলো দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা না করলে এত বড় ক্ষতি হতো না।

গত মৌসুমে নিজস্ব এয়ারক্রাফট দিয়ে হজযাত্রী পরিবহন করায় বিমানের লাভ হয় ৭০ কোটি টাকা। কিন্তু এয়ারক্রাফট ব্যবহারে অনভিজ্ঞ যাত্রীরা বিমানের যে ক্ষতি করেছেন তার সারতে ব্যয় হয়েছে ২৭০ কোটি টাকা। সংস্কার ব্যয় থেকে মুনাফা বাদ দিয়ে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দু’শ কোটি টাকা। আগামী হজে যাত্রী বেশি হওয়ায় বিমানকে ৪টি নতুন বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর উড়োজাহাজ ব্যবহার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন এয়ারক্রাফট পালকি, অরুণ আলো, আকাশ প্রদীপ ও রাঙাপ্রভাত দিয়েই হজ ফ্লাইট পরিচালিত হবে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ ক্ষেত্রে লাভের অঙ্ক কিছুটা বাড়লেও ক্ষতি হবে ৫ গুণের বেশি।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের কোনো এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাদের বহরের নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে না। হজ ফ্লাইটের জন্য তারা বড় আকারের উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়ে থাকে। কিন্তু বিমানের ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি নিজস্ব এয়ারক্রাফট দিয়ে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে। অন্যান্য রুটের যাত্রী বহনের জন্য এয়ারক্রাফট লিজ নেয়। এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে তারা মনে করেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত ৩ মাসের জন্য বড় আকারের ১টি উড়োজাহাজ ভাড়া নিলেই সব রুট ঠিক রেখেই নিরবচ্ছিন্ন হজ ফ্লাইট করা সম্ভব। এতে নতুন এয়ারক্রাফটগুলো নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পেত। পাশাপাশি রুট ঠিক রাখা যেত। কিন্তু তাতে লিজ বাণিজ্য না হওয়ায় সেদিকে যাচ্ছে না কেউ।

অভিযোগ উঠেছে, কোটি কোটি টাকার লিজ বাণিজ্যের জন্যই মূলত বড় জাহাজ না নিয়ে ছোট আকারের দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয়া হচ্ছে।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইল হেউগ বলেছেন, হজ ফ্লাইট চালানের জন্য লন্ডন, রিয়াদ, দাম্মাম, মাসকট ও কুয়ালালামপুর রুটে চলাচলকারী নিজস্ব ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এয়ারক্রাফট তুলে আনা হবে। ওই চারটি উড়োজাহাজ দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে হজ ফ্লাইট চালানো হবে। আর ওই সব রুটের ব্যাকআপ হিসেবে ছোট উড়োজাহাজ দেয়া হবে। এ জন্য ২টি উড়োজাহাজ লিজ নেবে বিমান। প্রয়োজনে কিছু রুটের ফ্লাইট কাটছাঁট করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অভিযোগ উঠেছে, বিমানের এ সিদ্ধান্তের নেপথ্যে আছে কোটি কোটি টাকার লিজ বাণিজ্য। বিমানের সাবেক এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এ লিজ বাণিজ্যের সঙ্গে কাজ করছে। ইতিমধ্যে এ সিন্ডিকেট মালদ্বীপ ও হাইফ্লাই নামে দুটি উড়োজাহাজ সংস্থার সঙ্গে গোপনে রফা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, বলাকা ভবনসংলগ্ন একটি হোটেলে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন ওই দুটি বিমান সংস্থার একাধিক এজেন্ট।

উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারী কোম্পানি খোদ বোয়িংয়ের মতে, হজ ফ্লাইট চালিয়ে কিছু টাকা লাভ করলেও বাস্তবে হজ শেষে দেখা যাবে ৪ উড়োজাহাজকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ৪০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। না করলে এয়ারক্রাফটগুলোর ওপর দীর্ঘ মেয়াদে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এটা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশির মতো অবস্থা। হজ ফ্লাইট চালানোর কারণে স্বল্প দূরত্বে ফ্লাইট পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিটি উড়োজাহাজের সাইকেল (ইঞ্জিনের ক্ষমতা) হারাবে। নষ্ট হবে ভেতরের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য। উড়োজাহাজের গড় আয়ুও কমে যাবে।

রিজেন্ট এয়ারের সাবেক সিইও আসিফ আহম্মেদ জানান, হজ ফ্লাইট করার জন্য ফ্লিট থেকে ৪১৯ আসনের এয়ারক্রাফট তুলে নিয়ে ওই সব রুটে ছোট উড়োজাহাজ দিলে ৬টি রুটে প্রতিদিন গড়ে ৭শ’ করে যাত্রী কমবে। এতে ৩ মাসে বিপুলসংখ্যক যাত্রী হারাবে বিমান। হজ শেষে আবার বড় এয়ারক্রাফট দিলেও দেখা যাবে যাত্রী নেই।

বিমানের সাবেক বোর্ড মেম্বার এম ওয়াহিদুল আলম বলেন, এটা করা হলে সংশ্লিষ্ট ৬টি রুটের যাত্রী ক্যাপাসিটি অনেক কমে যাবে। ওই সব যাত্রী ভবিষ্যতে আর বিমানে ভ্রমণ করবেন না। যা দীর্ঘ মেয়াদে পুরো সংস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিমানের পরিচালনা পর্যদের সদ্য সাবেক সদস্য আবুল কাসেম আহম্মেদ জানান, হজের জন্য নিজস্ব উড়োজাহাজ তুলে নেয়ায় গত বছর ২টি রুট বন্ধ এবং ৪টি রুটে ছোট উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট করানোর কারণে যাত্রীর অভাবে কমপক্ষে ৯০ কোটি টাকা আয় কম হয়েছিল। হজ শেষে সংশ্লিষ্ট রুটগুলোতে ফের বড় উড়োজাহাজ দিলেও আগের মতো যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। যার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। জানা গেছে, বর্তমানে লন্ডন, দুবাই, আবুধাবি, দাম্মাম রুটে ৪১৯ আসনের এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট করলেও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ১৮০ থেকে ২শ’ জন। প্রতি ফ্লাইটে ২শ’ আসন ফাঁকা থাকছে।

জানা গেছে, ২০১১ সালের আগস্ট ও নভেম্বরে বিমানবহরে যোগ হয় নতুন দুটি উড়োজাহাজ- পালকি ও অরুণ আলো। ওই দুটি উড়োজাহাজের ক্রয়মূল্য ছিল প্রতিটি ১ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। উড়োজাহাজ দুটির টাকা পরিশোধে বিমানকে ওই বছর ২ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিতে হয়েছিল। কিন্তু মাত্র এক বছর হজ ফ্লাইট করার কারণে সম্পূর্ণ নতুন দুটি উড়োজাহাজের অবস্থা এখন শোচনীয়। বিমানের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, হজ ফ্লাইট করার কারণে পালকি ও অরুণ আলোর ভেতরের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। অধিকাংশ সিটের হাতল ভেঙে যাওয়ায় সেগুলো পরিবর্তন করতে হয়েছে। খাবার রাখার বক্সগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এয়ারকন্ডিশন ঠিকমতো কাজ করছে না। অনেক এন্টারটেইনমেন্ট যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। মোটকথা ৪ বছরে ২৪শ’ কেটি টাকার দুটি এয়ারক্রাফটের আয়ু কমে গেছে। বোয়িং কর্তৃপক্ষের মতে, হজ ফ্লাইট না করে যদি সাধারণ ফ্লাইট করা হতো তাহলে আরও ১০ বছরেও এ ধরনের উড়োজাহাজ একদম ব্র্যান্ডনিউ থাকত।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, এবারের হজে বাকি দুটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর আকাশ প্রদীপ ও রাঙাপ্রভাতকেও ব্যবহার করা হবে। এই দুটি উড়োজাহাজ কিনতে বিমানকে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিতে হয়েছিল। কিন্তু মূল্যবান এ জাহাজ দুটিকেও এবার হজ ফ্লাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আকাশ প্রদীপ ও রাঙাপ্রভাতের ভাগ্যও আগের দুটি উড়োজাহাজের মতো হবে। বিমানের ফিন্যান্স বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, নতুন ৪টি এয়ারক্রাফট ক্রয় করতে বিমানকে লোন নিতে হয়েছে ৬ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা লোন পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু যেভাবে এয়ারক্রাফটগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে, লোন শেষ হওয়ার আগে এগুলোর সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে।

খোদ বিমানের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হজযাত্রীদের অধিকাংশরই বিমানে চলাচল করার অভিজ্ঞতা নেই। টয়লেট ব্যবহার, খাওয়া-দাওয়া, পানি ফেলা ইত্যাদি বিষয়ে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। হজ ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে একজন ফ্লাইট স্টুয়ার্ড বলেন, হজযাত্রীরা উড়োজাহাজে উঠেই কার্পেটে পানের পিক, পানি ও খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলে একাকার করে ফেলেন। আসনের ওপর দাঁড়িয়ে লাগেজ উঠাতে গিয়ে সিটের হাতল ভেঙে ফেলেন। অডিও-ভিডিও প্যানেল ও ভিডিও স্ক্রিন নষ্ট করেন। টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেন। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় হজযাত্রীদের কোনো কিছু নিষেধও করা যায় না। ওই ক্রু আরও জানান, এসব কারণে সৌদি এয়ারলাইন্সসহ পৃথিবীর অন্যান্য বিমান সংস্থা হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে অপেক্ষাকৃত পুরনো ও ভাড়া করা বড় উড়োজাহাজ দিয়ে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.