বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার জাপানকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণকাজ না দিলে দেশটি ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন না করার হুমকি দিয়েছে। গত মঙ্গলবার থার্ড টার্মিনাল নিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাপান এ হুমকি দেয়। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জাপানের প্রতিনিধিত্ব করেন ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার তাকেশি মাটসুনাগা, জাইকার বাংলাদেশ অফিসের প্রধান মিকিও হাতেদা এবং জাইকার সিনিয়র রিপ্রেজেনটেটিভ টাকু ইয়ামাবি। বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল হাসনাত মো. জিয়াউল হকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বৈঠকের একপর্যায়ে জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার তাকেশি মাটসুনাগা বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে কোনো কাজ পাই না। আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের কাজ দেওয়া হোক।’ জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, এবারের কাজটি চীন করবে। জাপানকে অন্য কাজ দেওয়া হবে। মন্ত্রীর এ কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি জাপানি প্রতিনিধিদল। তারা হতাশা নিয়ে বলে, ‘আমরা বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। থার্ড টামিনালের নির্মাণ ছোট অঙ্কের একটি কাজ। এর পরও আমরা প্রতীকী অর্থে এই ছোট কাজটিই পেতে চাই।’ জবাবে রাশেদ খান মেনন তাদের জানান, থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ চীনই করবে। মন্ত্রীর এই উত্তরে জাপানি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বলেন, ‘থার্ড টার্মিনাল নির্মাণকাজ আমাদের না দেওয়া হলে আমরা এখানকার প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিতে পারি। বিশেষ করে ভবিষ্যতে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।’
এই পর্যায়ে রাশেদ খান মেনন তাঁদের জানান, ‘তোমরা শেষ সময়ে এই কাজের জন্য মরিয়া হয়ে গেছ কেন? আমি গত বছর তোমাদের দেশে গেলাম। সে সময় তো বলোনি।’
জবাবে জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার বলেন, ‘আমরা আগেই জানিয়েছি। তুমি জাপান সফর করেছ ২০১৫ সালে। অথচ আমরা তোমাদের কাছে এই কাজে অংশ নেওয়ার কথা ২০১৪ সালেই জানিয়েছি। তোমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে আমরা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছি।’
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, জাপানের এ হুমকি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে অবহিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, জাপানকে কাজের প্রস্তাব দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, মূল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে। তারা জাপানের প্রস্তাবটাই তালিকাভুক্ত করেনি। জাপানকে এড়িয়ে চীনকে প্রায় সব বড় কাজ দেওয়ার পেছনে আর্থিক লেনদেন রয়েছে। চীন প্রায় সব কাজেই টাকা ঢালে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খুশি করে। কিন্তু জাপানের এ কালচার নেই। এ জন্য কর্মকর্তারা প্রায়ই জাপানের প্রস্তাব ফেলে দেন বা আমলে নেন না। এ ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন’—এই নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের জন্য চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তারা নিজেরাই তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছে। মোট ১৩টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এই নির্মাণকাজ পেতে চায়। এর মধ্যে ১১টিই চীনের। অন্য দুটি মালয়েশিয়ান কম্পানি।
অনেক প্রতিষ্ঠান থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ করতে চাওয়ায় সরকার তাদের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে একটি শর্ট লিস্ট করার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল হাসনাত মো. জিয়াউল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একটি শর্ট লিস্ট তৈরি করে। এসব কম্পানির কাছে তাদের অর্থায়নের উৎস, অর্থায়নের শর্ত এবং অর্থায়নের ধরন জানতে চাওয়া হয়। ইতিমধ্যে তারা এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব জমা দিয়েছে। শর্ট লিস্টের ছয়টি কম্পানির মধ্যে চারটি চীনা কম্পানি জিটুজি পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়।
তৃতীয় টামিনাল নির্মাণের জন্য বিভিন্ন কম্পানির দেওয়া প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘আমরা দাখিলকৃত প্রস্তাবগুলো পরীক্ষ-নিরীক্ষ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিমানবন্দর নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছি। থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের ক্ষেত্রে শুধু পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর নির্মাণের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সুপারিশ করেছি। এর মধ্যে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া বাকি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করতে পারবে।’ কমিটি চূড়ান্তভাবে জিটুজি পদ্ধতিতে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে তিনটি কম্পানিকে নির্বাচন করেছে। এগুলো হলো বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ, চায়না এয়ারপোর্ট কনস্ট্রাকশন গ্রুপ করপোরেশন এবং চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কম্পানি লিমিটেড। এ ছাড়া পিপিপির আওতায় নির্মাণ করলে মালয়েশিয়ান কম্পানি দুটির মধ্য থেকে যেকোনো একটিকে বাছাই করার সুপারিশ করেছে কমিটি।