দুবাইয়ের একটি ক্রিমেটোরিয়ামের (শবদাহের স্থান) সামনের দৃশ্য। ক্রিমেটোরিয়ামের ফটকের সামনে অ্যাম্বুলেন্সের পাশে রাখা হয়েছে কফিনে মোড়া একটি মরদেহ। মৃতের সঙ্গে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘণ্টাখানেক মরদেহটি নিয়ে অপেক্ষা করলেন। কোনো স্বজন বা বন্ধু মৃত ব্যক্তিটিকে শেষবারের মতো দেখতে চাইলে তাদের সে সুযোগ দেয়াটাই উদ্দেশ্য। কিন্তু কেউ আসেনি। সুরক্ষা পোশাক পরা স্বাস্থ্যকর্মীরাই মৃতকে শেষ বিদায় জানিয়ে মরদেহটিকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন শবদাহের চুল্লির দিকে।
সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে চার স্বাস্থ্যকর্মী সতর্কতার সঙ্গে সাদা প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়া মরদেহটিকে চুল্লির দিকে নিয়ে গেলেন। শবদাহের পর রুপালি একটি বাক্সে সংরক্ষণের জন্য রাখা হলো মরদেহের পোড়া ছাই। এভাবেই নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পরবাসে স্বজন-বন্ধুহীন অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ভারতীয় এক অভিবাসী শ্রমিক।
সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ (ইউএই) মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ সেখানে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকরা। ওই অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং খাত, আবাসন ও শিল্পোৎপাদন খাত পুরোপুরি অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল।
পরিবারের ভবিষ্যৎ জীবন নিশ্চিতের তাগিদে এ শ্রমিকদের অনেকেই বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। এদের অনেকেরই স্বপ্ন একদিন দেশে ফিরে কোনো ব্যবসা খুলে বসবেন। অনেকেই পয়সা জমিয়েছেন দেশে পরিবারের বসবাসের ঠাঁই হিসেবে একটি বাড়ি তুলবেন বলে।
কিন্তু প্রবাসে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে এদের অনেকেরই শেষ ঠাঁই হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মাটিতে। কেউ কেউ পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছেন সেখানকার চুল্লিতে দাহ হয়ে। কেউ নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়ার অর্থ হলো, তার মরদেহটি আর দেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে যে দেশে মৃত্যু, মরদেহ সেখানেই দাফন বা দাহ করে দেয়ার নিয়ম রয়েছে।
দুবাইয়ের এক সনাতনী শ্মশানের ব্যবস্থাপক ঈশ্বর কুমার বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানালেন, গোটা পৃথিবীটাই বদলে যাচ্ছে। কেউ এখন আর মরদেহের কাছে আসে না। কেউ ছোঁয়ও না। বিদায়ও জানায় না। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ার আগে এখানে প্রত্যেক মৃতের সঙ্গে অন্তত ২০০-২৫০ জন আসতেন ফুল নিয়ে শোক প্রকাশ করতে। এখন যারই মৃত্যু ঘটছে, বিদায় নিচ্ছেন একাই।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত এসব দেশে মোট ১৬৬ বিদেশী নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ২৬ হাজার ৬০০ জনের। এসব বিদেশী নাগরিকের অধিকাংশই সেখানে গিয়েছেন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ও ফিলিপাইন থেকে।
৫০ বছর বয়সী ভারতীয় ওই অভিবাসী দুবাইয়ের একটি ট্যুরিস্ট কোম্পানির অংশীদার ছিলেন। তার শবদাহের কিছুক্ষণ আগে একই ক্রিমেটোরিয়ামে আরেক বিদেশীর মরদেহ পোড়ানো হয়েছিল। ৪০ বছর বয়সী এক ফিলিপাইনি বিউটিশিয়ান। এদের উভয়েরই একটা জায়গায় হুবহু মিল রয়েছে। সেটি হলো উভয়েরই ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে ‘কভিড নিউমোনিয়া’।
তাদের উভয়েরই মরদেহ পোড়া ছাই সংরক্ষণ করা হচ্ছে হাইপারমার্কেট থেকে কেনা রুপালি বাক্সে। যদি দুবাইয়ে তাদের পরিবার বা স্বজন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে এ ছাইভর্তি বাক্স তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অন্যথায় তা তুলে দেয়া হবে দুবাইয়ে স্থাপিত তাদের নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের কাছে।
ওই ক্রিমেটোরিয়াম ফ্যাসিলিটির আরেক ব্যবস্থাপক সুরেশ গালানি বলেন, এখানে যাদের মরদেহ সত্কার করা হয়, তাদের অনেকেই পেশায় শ্রমিক। অভিবাসী হওয়ায় এখানে তাদের কোনো পরিবারের সদস্য নেই। আগে তাদের সঙ্গে তাদের কর্মস্থল থেকে তাদের সহকর্মীরাই আসতেন।
মহামারীর বিস্তার ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সব ধরনের বাণিজ্যিক ফ্লাইট এখন বন্ধ। অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে দেশগুলোয় এখন কাজকর্মও নেই। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকার এখন অভিবাসী শ্রমিকদের নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবাসিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে।
কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মরদেহের ব্যবস্থাপনা আরেক বড় চ্যালেঞ্জ। ভয়াবহ মাত্রায় ছোঁয়াচে কোনো রোগের উপস্থিতির অর্থ হলো, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মরদেহ অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দাফন বা দাহ করে দিতে হবে। অন্যথায় রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ে।
আবার সৌদি আরবে মুসলিম যেসব অভিবাসী মারা যান তাদের অনেকেরই ইচ্ছা থাকে সেখানেই তাদের দাফন হোক। এর কারণটি সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয়।
সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এএফপিকে জানান, এখানে যারা মারা যান, তাদের অনেকেই বা তাদের পরিবারের সদস্যরা চান, এখানেই তাদের দাফন হোক।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৫৭ বছর বয়সী আফগান ওয়াজির মোহাম্মদ সালেহর কথা। ১৯৮০-এর দশকে সোফিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময়ে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে সৌদি আরব চলে গিয়েছিলেন তিনি। এর পর থেকেই পুণ্য নগরী মদিনায় বসবাস করছিলেন তিনি। সেখানে একটি স্টেশনারি দোকানের ব্যবসা করতেন তিনি।
গত সপ্তাহে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। মদিনায় তার গোটা পরিবার ও অনেক আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। কিন্তু তার দাফন হয়েছে মাত্র চারজনের উপস্থিতিতে। এ চারজনের সবাই ওয়াজির মোহাম্মদ সালেহর ছেলে।
ওয়াজির মোহাম্মদ সালেহর ভাতিজা আমেদ খানের জন্ম সৌদি আরবেই। সেখানে বর্তমানে সেলস এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। স্মার্টফোনের ভিডিও মারফত চাচার মরদেহ দাফনের দৃশ্যটি অবলোকন করেছেন তিনি। আমেদ খান জানালেন, তার চাচার সারা জীবনের ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর তাকে মদিনাতেই দাফন করা হোক। মহামারী এসে তার সে স্বপ্নকে সত্যি করে দিল।
তিনি বলেন, এমন কেউ নেই যিনি চাইবেন মদিনায় মৃত্যু হওয়ার পর তাকে অন্য কোথাও দাফন করা হোক। এখানকার ভূমি বেহেশতের অংশ হিসেবে পরিচিত।