৪৪ বছরেও উদ্যোগ নেই ইউরেনিয়াম উত্তোলনের

৪৪ বছরেও উদ্যোগ নেই ইউরেনিয়াম উত্তোলনের।

মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার হারাগাছায় ও সিলেটের জৈন্তাপুরে মাটির নিচে অব্যবহৃতভাবেই পড়ে আছে মূল্যবান খনিজ সম্পদ ইউরেনিয়াম। দেশে ৪৩ বছর আগে মূল্যবান ইউরেনিয়ামের সন্ধান মিললেও নেই উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ। ইউরেনিয়াম উত্তোলন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব । নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জাপান, জার্মান ও যুক্তরাষ্ট্র ইউরেনিয়ামের বড় গ্রাহক।

এক সময় ইউরেনিয়াম উত্তোলনে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকলে বর্তমানে সেই নিষেধাজ্ঞা নেই। তুবুও ইউরেনিয়াম উত্তোলনে পদক্ষেপ না নেয়ায় হতাশ সচেতন মহল। বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে আমাদের দেশেপ্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের মানও ভালো।
হারাগাছা ও জৈন্তাপুর থেকে সংগৃহিত মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, এখানে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির হার ৫০০-১৩০০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। বিশ্বের যেসব খনি থেকে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোতে ৩শ থেকে এক হাজার পিপিএম ইউরেনিয়াম রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার হারাগাছায় সন্ধান মেলে দেশের প্রথম ইউরেনিয়াম খনির। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল হারাগাছা পাহাড়ে অনুসন্ধান চালিয়ে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির সম্ভবনার ব্যাপারে নিশ্চিত হন। এরপর ওই পাহাড়কে তেজস্ক্রিয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে কমিশন। কিন্তু বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম ব্যবহার ও উত্তোলনের অনুমতি না থাকায় এ প্রকল্পের কাজ ওই পর্যন্তই থেমে যায়।

এর ১০ বছর পর ১৯৮৫ সালে সিলেটে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবারও আলোচনায় আসে হারগাছার ইউরেনিয়াম। এ সময় ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু হয়। সেই সঙ্গে সিলেটের বিভিন্ন স্থানেও ইউরেনিয়াম অনুসন্ধান চালায় আণবিক শক্তি কমিশন। অনুসন্ধান চালিয়ে সিলেটের জৈন্তাপুরে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পায় পারমাণু শক্তি কমিশন। অনুসন্ধান কাজে তাদেরকে সহায়াতা করেছিল ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর। কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকায় ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেলেও আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধে কারণে জৈন্তাপুরে ইউরেনিয়াম খনি নিয়ে গবেষণা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।

ওই সময় মৌলভীবাজারের জুড়ির হারাগাছা ও সিলেটের জৈন্তাপুর থেকে সংগৃহিত মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রতি ১০ লাখ মাটি কণার মধ্যে রয়েছে ৫০০-১৩০০ ইউরেনিয়াম কণা। অর্থাৎ পরীক্ষিত স্থানের মাটিতে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির হার ৫০০-১৩০০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। আবারও থেমে যায় সব প্রক্রিয়া কারণ বাংলাদেশের ইউরেনিয়াম উত্তোলনের অনুমতি ছিল না।

এর ছয় বছর পর ১৯৯১ সালে মৌলভীবাজারের হারাগাছায় ফের শুরু হয় অনুসন্ধান কাজ। ওই সময় হারাগাছা থেকে সংগৃহিত ইউরেনিয়াম আকরিক জাপানের আণবিক শক্তি কমিশনের জ্বালানি বিষয়ক গবেষণাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষায় হারাগাছায় উন্নতমানের ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়। পরে ওই এলাকায় কয়েকটি কূপ খনন হলেও আন্তর্জাতিক বিধি নিষেধের কারণে শেষ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

তবে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতির সঙ্গে সঙ্গে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের সব বিধিনিষেধ উঠে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে গড়ে ওঠতে পারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে একটি সেমিনারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সম্মেলন কক্ষে তৎক্ষালীন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ কে এম ফজলে কিবরিয়া জানান, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে মূল্যবান পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চলে এই তেজস্ক্রিয় খনিজের ঘনত্বও অনেক বেশি। এখন সরকার এগিয়ে এলেই এই খনিজ থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। ড. কিবরিয়ার এ তথ্যের পর আবার উঠে আসে সিলেট ও মৌলভীবাজারে ইউরেনিয়াম প্রাপ্তির বিষয়টি।

২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর মৌলভীবাজার সফরে এসে তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক বলেন, হারাগাছার ইউরেনিয়াম আকরিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ না থাকায় এ প্রকল্প থেকে শিগগিরই ইউরেনিয়াম উত্তোলন কাজ শুরু হবে।

এছাড়া ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে একটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেন। তবে সরকারের এমন আশ্বাসের পরও ইউরেনিয়াম উত্তোলনে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

২০০৯ সালে এ অনুমতি দেয়ার পর সিলেট অঞ্চল থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চমহল থেকে আশ্বাস দেয়া হলেও আজও ইউরোনিয়াম উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মুহিবুল আলম বলেন, ইউরেনিয়াম খুবই মূল্যবান এবং সেনসেটিভ বিষয়। সঠিক উপায়ে উত্তোলন না করতে পারলে জীব-বৈচিত্রের ওপর বড় আঘাত আসবে। ইউরেনিয়াম উত্তোলন করার যে আধুনিক প্রযুক্তি তা আমাদের কাছে নেই, রাশিয়াসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ এ ব্যপারে অভিজ্ঞ। তাদের সহযোগিতায় জীববৈচিত্রকে নিরাপদ রেখে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করতে পারলে রাষ্ট্র লাভবান হবে।

তিনি আরও বলেন, ইউরেনিয়াম দেশের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহারের পাশাপাশি উন্নত বিশ্বে রফতানি সম্ভব। তবে কি পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুদ আছে এবং তা উত্তোলনযোগ্য কি-না এসব বিশেষজ্ঞ দিয়ে দ্রুত যাচাই করা উচিত।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.