লন্ডনে বিমানের কেবিন ক্রুকে যৌন নির্যাতন সাজানো নাটক

imagesলন্ডনের হোটেলে বাংলাদেশ বিমানের এক কেবিন ক্রুর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সাজানো নাটক। অভিযোগ উঠেছে, ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগের চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রনজু ও স্টুয়ার্ড অপুক মুমের সিনহাকে ফাঁসানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে বিমানবালা নাবিলাকে দিয়ে এ নাটক সাজানো হয়েছিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া বিমান কেবিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন বানচাল ও চিফ পার্সার যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সেজন্য ওই নাটক তৈরি করা হয়েছিল। এর সঙ্গে বিমান কেবিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে অংশ নেয়া অপর এক গ্রুপের কয়েকজন শীর্ষ নেতা সরাসরি জড়িত ছিলেন। নাবিলা বিমানের রহস্যময় নারী হিসেবে পরিচিত।

এ বিষয়ে নাবিলার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পত্রিকায় এ নিয়ে কোনো ধরনের রিপোর্ট না করার জন্য হাতজোড় করে অনুরোধ করেন। বলেন, তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এ বিষয়ে কোনো রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তার বিয়ে ভেঙে যাবে। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে চিফ পার্সার রনজুর বিরুদ্ধে নালিশ করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি কোনো অভিযোগ করেননি। অপরদিকে চিফ পার্সার রনজুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেকে নির্দোষ উল্লেখ করে বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত বছরের ২৭ আগস্ট লন্ডনে বিমানের ক্রুদের থাকার জন্য ভাড়া করা হোটেলে ওই কথিত যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। তবে বিষয়টি নাবিলা বিমান ম্যানেজমেন্টকে লিখিতভাবে জানান প্রায় ৪ মাস পর ডিসেম্বরের শেষদিকে। আর বিমান কর্তৃপক্ষ অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে আরও ১ মাস পর জানুয়ারি মাসে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যৌন হয়রানির ৪ মাস পর দায়ের করা অভিযোগ কোনোভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এ ধরনের অভিযোগও রহস্যজনক। মূলত কাউকে ঘায়েল করার জন্য এ ধরনের অভিযোগ করা হয়ে থাকে। তারা বলছেন, যদি সত্যি সত্যি এমনটি ঘটত তাহলে অভিযোগকারী ঘটনার পরপরই ইচ্ছা করলে লন্ডনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে জানাতে পারতেন। তা তো করেনইনি, দেশে ফিরে এসেও জিডি করেননি। বিমান ম্যানেজমেন্ট দূরের কথা তার বিভাগেরও ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকেও জানাননি।

বিমানেরই একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, কথিত যৌন হয়রানির পর একাধিকবার চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রনজু ও স্টুয়ার্ড অপুক মোমের সিনহার সঙ্গে অভিযোগকারী নাবিলা একসঙ্গে ফ্লাইট করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগের এক নারী কেবিন ক্রু জানান, নাবিলা বিমানের রহস্যময় নারী। এর আগেও সে একাধিক পুরুষ কেবিন ক্রুর বিরুদ্ধে মৌখিকভাবে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেননি।

ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগ সূত্রে জানা গেছে কথিত যৌন হয়রানির পরের দিন গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর নাবিলা ও রনজু একসঙ্গে বিজি-৩০২৫ ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। ওইদিন কোনোভাবেই বোঝা যায়নি এর আগে তাদের দুজনের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বিমানের নিয়ম অনুযায়ী কোনো মহিলা কেবিন ক্রু যদি মৌখিকভাবে কোনো পুরুষ ক্রুর সঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনায় অপারগতা দেখান সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ কর্মীকে ওই ফ্লাইট থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সেদিনও নাবিলা রনজুর বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ করেননি।

নাবিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রায়ই তিনি বিমান থেকে উধাও হয়ে যান। এরপর অসুস্থ (সিক) রিপোর্ট করে কাজে যোগদান করেন। গত এক বছরে তিনি ৮০ বারের বেশি অসুস্থ দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন, যা বিমানের ইতিহাসে রেকর্ড। কিছুদিন আগেও একনাগাড়ে ২২ দিন অনুপস্থিত থেকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ছিলেন বলে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরিতে যোগ দেন। যদিও অভিযোগ আছে, তিনি যে সময়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ছিলেন বলে রিপোর্ট দিয়েছেন ওই সময়ে তাকে বিমানের একটি ইনফ্লাইট ভিডিওতে শুটিং করতে দেখা গেছে। এ ঘটনাটি বর্তমানে বিমানে তদন্তাধীন রয়েছে। এর আগেও ফ্লাইট চালাকালীন তিনি একজন পুরুষ কেবিন ক্রুর বিরুদ্ধে ১৮ বার গায়ে হাত দেয়ার অভিযোগ এনে ককপিটে গিয়ে পাইলটকে নালিশ করেছিলেন বলে চাউর আছে। কিন্তু ওই ঘটনায়ও তিনি কারও বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রনজুর এ বছর বিমান কেবিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনে সভাপতি পদে নির্বাচন করার কথা ছিল। একই সঙ্গে চিফ পার্সার (অপারেশন) ও চিফ পার্সার (ট্রেনিং) নামে দুটি পদে পদোন্নতির জন্যও তার নাম তালিকার শীর্ষে ছিল। নিয়ম অনুযায়ী চিফ পার্সারদের মধ্য থেকেই এ দুটি পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পদ দুটি ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগের সবচেয়ে লোভনীয় পদ। এ পদে পদোন্নতি পেলে অফিসিয়াল স্ট্যাটাস অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিমান প্রধান কার্যালয়ে ডিউটি ও মাসে ৩২ ঘণ্টা ফ্লাইট পাওয়া যায়। এছাড়া এই পদ থেকে ফ্লাইট সার্ভিস ম্যানেজার ও ডিজিএম হওয়ার সুযোগ আছে। তদন্তকারী সংস্থা মনে করছে এ কারণে চিফ পার্সার রনজুর প্রতিপক্ষ গ্র“প যাতে তিনি এ পদের অযোগ্য হন ও কেবিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পদে নির্বাচন করতে না পারেন সেজন্য নাবিলাকে দিয়ে যৌন নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করান। এর সঙ্গে বিমান ম্যানেজমেন্টের একটি গ্রুপও জড়িত আছে।

১৮ জানুয়ারি যখন বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগ থেকে ওই দুটি পদের জন্য লেটার অব ইন্টারেস্ট চাওয়া হয় তার পরদিনই রহস্যজনকভাবে রনজুর বিরুদ্ধে তদন্তের চিঠি দেয় বিমান ম্যানেজমেন্ট। এরপর ২ মে কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই তাকে ও স্টুয়ার্ড সিনহাকে গ্রাউন্ডেট ও পরে রনজুকে চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

বিমানের একজন কর্মকর্তা জানান, নাবিলার লিখিত অভিযোগে চিফ পার্সার রনজু ও ফ্লাইট স্টুয়ার্ড অপুক মুমের সিনহা দুজনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট রহস্যজনক কারণে অপুক মুমের সিনহাকে গ্রাউন্ডেট ও চাকরিচ্যুত না করে শুধু রনজুর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। অপুক মুমের সিনহা বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার আত্মীয় হওয়ায় বিমান ম্যানেজমেন্ট ভয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনেনি।

বিমানের অপর এক সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় বিমান কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ৫ সদস্যের ওই কমিটির সদস্য ছিলেন বিমানের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ট্রেনিং) ডালিয়া আহমেদ, উপ-মহাব্যবস্থাপক (পার্সোনাল), উপ-মহাব্যবস্থাপক (লিগাল) ও আইন সালিশ কেন্দ্রের দুজন পদস্থ নারী সদস্য।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে ওই তদন্ত টিম দীর্ঘদিন তদন্ত করে অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি। এরপর তারা ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে অভিযোগটি ডিসমিস করে দেন। কিন্তু তারপরও বিমান ম্যানেজমেন্ট রনজুর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে বিমানের জেনারেল ম্যানেজার শাকিল মেরাজকে নতুন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। বর্তমানে অভিযোগটি তদন্তাধীন রয়েছে।

কেবিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশনের নবনির্বাচিত সভাপতি আকতারুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক দস্তগীর আহমেদের কাছে রনজু ও সিনহার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তারা দুজনেই পুরো ঘটনাটি পরিকল্পিত ও সাজানো বলে জানান। বিষয়টি নিয়ে তারা শিগগিরই বিমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দীনের কাছে যাবেন বলেও জানান। তাদের ধারণা একমাত্র বিমান চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানাতে পারলেই সুবিচার পাওয়া যাবে।

Forward to Friend

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.