ঠিক পাঁচ বছর আগে সিরিয়াতে শুরু হয়েছিল দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পদত্যাগের দাবিতে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। তিউনেশিয়ায় শুরু হওয়া আরব বসন্তের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সেখানেও। কিন্তু যে পরিবর্তনের আশায় আন্দোলন শুরু করেছিল সিরিয়াবাসী, তার কিছুই হয়নি। হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। শান্তির পরিবর্তে এসেছে অশান্তি। দীর্ঘস্থায়ী একটি যুদ্ধ উপহার পেয়েছে সিরীয়রা। এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ। বিশ্বশক্তিগুলো পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধ।
এমনটাতো প্রত্যাশা করেনি সিরিয়ার মানুষ। তবে কেন এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ? পিতা হাফেজের উত্তরসূরি হিসেবে ২০০০ সালে সিরিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন বাশার আল আসাদ। চলমান সংঘাত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক অভিযোগ ছিল সিরিয়ার মানুষের। বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব আর রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনসহ নানা সমস্যা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে।
আরব বসন্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দেরায় গণতন্ত্রপন্থীরা শুরু করে শান্তিপূর্ণ একটি বিক্ষোভ। এরপর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনটি। বিক্ষোভকারীদের দমাতে তাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে আসাদ বাহিনী। বিক্ষোভ যত ছড়িয়ে পড়ে নির্যাতনের মাত্রাও তত কঠোর হতে থাকে।
এরই এক পর্যায়ে নিজেদের রক্ষার জন্য বিরোধীরা হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। স্থানীয় পর্যায় থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে হটাতে শুরু করে তারা। ‘বিদেশি মদদপুষ্ট’ সন্ত্রাসবাদকে উপড়ে ফেলে দেশকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আসাদ। এতেও কোনো কাজ হয়নি। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একটি দল সরকারের বিরুদ্ধে গঠন করে বিদ্রোহী ব্রিগেড। ছড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধ।
ন্যায় নীতির চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় আসাদের পক্ষে বা বিপক্ষে যুদ্ধ করার বিষয়টি। যুদ্ধে ইরান, রাশিয়া, সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো আঞ্চলিক এবং বিশ্বশক্তিগুলোর অংশগ্রহণ একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আসাদ কিংবা বিদ্রোহীদের পক্ষে তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন যুদ্ধকে আরো তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় সিরিয়া।
সেখানে শিয়া-সুন্নি বিভেদ তৈরি করে বিদেশি শক্তিগুলো। উভয় পক্ষই একে অপরের ওপরে চালায় নির্মমতা। এতে ক্ষীণ হয়ে আসে রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনার আলো। সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায় জঙ্গি গোষ্ঠি ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠি দখল করে নেয় সিরিয়ার অনেক অঞ্চল। দেশটির উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের বিশাল একটি এলকা দখল করে নেয় আইএস। একদিকে বাশার বাহিনী, বিদ্রোহী গোষ্ঠি এবং কুর্দিদের মধ্যে চলতে থাকে যুদ্ধ। অপরদিকে চলতে থাকে রাশিয়ার আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিমান হামলা।
সিরিয়ায় রুশ স্বার্থ সংরক্ষণে আসাদকে চায় রাশিয়া। আর এ কারণেই ২০১৫ সাল পর্যন্ত কয়েকটি জায়গায় বাশার বাহিনীর পরাজয়ের পর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ‘সরকারের পক্ষে’ সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করে রুশ বিমান বাহিনী। মস্কো বারবার জোরালোভাবে দাবি করে আসছে, শুধু বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করেই বিমান হামলা চালাচ্ছে তারা। তবে মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, রাশিয়া মূলত পশ্চিমা সমর্থিত বিদোহীদের লক্ষ্য করেই হামলা চালাচ্ছে।
পরিস্থিতি অনেকটা বাশারের পক্ষে যাওয়ায় ছয় মাস পরে এসে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ সিরিয়া থেকে নিজের বিমান বাহিনী প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার ভাষায়, ‘মিশন সম্পন্ন হয়েছে।’ এ যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ইরানও। আরব অঞ্চলে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র আসাদ। লেবাননের শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহে ইরানের প্রধান পথ সিরিয়া। আসাদের পক্ষে সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ এবং বিভিন্ন অস্ত্র সরবরাহ করেছে দেশটি। আসাদকে ঋণ এবং তেল সরবরাহও করেছে ইরান। যুদ্ধ নিয়োগ দিয়েছে শত শত সেনা।
এদিকে সিরিয়ার ‘মডারেট’ বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তা সংখ্যায় কম। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ভয়, বিদ্রোহীদের বেশি এবং উন্নত অস্ত্র দিলে তাতে জিহাদিরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরেই সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে মার্কিন বাহিনী। তবে তারা আসাদ বাহিনীর ওপর কোনো হামলা চালায়নি। প্রতিপক্ষ ইরানকে রুখতে বিদ্রোহীদের সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে শুরু করে সৌদি আরব।
সেখানকার আরো একটি আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক। থেমে থাকেনি তারাও। বিদ্রোহীদের নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে দেশটি। তবে মার্কিন বিমান হামলা বন্ধে বারবারই আহ্বান জানিয়ে আসছে তুরস্ক। তাদের ধারণা, আইএসের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলা তুরস্কের নিষিদ্ধ ঘোষিত কুর্দি সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টিকে (পিকেকে) আরো শক্তিশালী করবে। কারণ আইএস এবং পিকেকে পরস্পর পরস্পরের শত্রু।
এদিকে জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত পাঁচ বছরের যুদ্ধে সিরিয়ায় নিহত হয়েছে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ। এ পরিসংখ্যান গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত। কারণ ২০১৫ সালের আগস্টে তথ্য হালনাগাদ বন্ধ করে দেয় জাতিসংঘ। একটি পর্যবেক্ষক সংগঠনের মতে, সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ৭০ হাজার। অবশ্য সম্প্রতি একটি থিংক ট্যাংক জানিয়েছে, সিরিয়া যুদ্ধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণে নিহতের সংখ্যা চার লাখ ৭০ হাজার। এছাড়া যুদ্ধের ভয়াবহতায় সিরিয়া ছেড়েছে দেশটির ৪৮ লাখ লোক। আর আভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন হয়েছে ৬৫ লাখ সিরীয়।
যুদ্ধে নিগ্রহের শেষ নেই সিরিয়াবাসীর। ৭০ ভাগ মানুষই পায় না বিশুদ্ধ পানি। ৬০ লাখ শিশুসহ দেশটিতে বর্তমানে অবস্থানরত ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে মানবিক সহায়তা দিতে ২০১৬ সালেই দরকার ৩.২ বিলিয়ন ডলার। দেশটির প্রতি তিনজন মানুষের একজন পায় না পর্যাপ্ত খাবার। ২০ লাখেরও বেশি শিশু বঞ্চিত শিক্ষার অধিকার থেকে। আর দারিদ্য সীমার নিচে বাস করে পাঁচ জনে চারজন। সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এখনো অবরুদ্ধ হয়ে আছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ, যাদের কাছে ত্রাণ সহায়তাও পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।
রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে কোনো পক্ষই রাজি হচ্ছে না পরাজয় মেনে নিতে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বারবার আহ্বান সত্ত্বেও সাড়া দিচ্ছে না কেউ। ২০১২ সালে জেনেভায় একবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল যুদ্ধ নিরসনে পারস্পারিক সম্মতির ভিত্তিতে পূর্ণক্ষমতাসম্পন্ন একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের। তা কাজে আসেনি। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার জেনেভা উদ্যোগ ভেস্তে যায়। বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় আপত্তি জানায় আসাদ সরকার।
সিরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে জেনেভায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল অনুমোদিত একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়। এতে যুদ্ধবিরতি এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সিরিয়ার আলেপ্পোতে আসাদ বাহিনীর অপরাধ ইস্যুতে তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে মার্চে আবার শুরু হয় আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যস্থতায় বর্তমানে সিরিয়াতে চলছে একটি যুদ্ধবিরতি। পুরোপুরি কার্যকর না হলেও ওয়াশিংটনের ভাষ্যমতে, এতে ৯০ ভাগ সহিংসতা কমে এসেছে। সবার প্রত্যাশা এর মধ্য দিয়েই শেষ সিরিয়ার যুদ্ধ। নিজেদের সোনালী দিনগুলোতে আবার ফিরে যাবে দেশটির কোটি কোটি মানুষ।