থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় শত শত অবৈধ অভিবাসী উদ্ধার হওয়ায় মানব পাচার নিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আট হাজার মানুষ সাগরে ভাসছে এমন খবর প্রকাশের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ জোরালো হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা মানব পাচার বন্ধ এবং ওই লোকদের উদ্ধারে এ অঞ্চলের দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী প্রায় চারশ’ লোক বহনকারী যন্ত্রচালিত একটি নৌকা তাদের জলসীমা থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলে যেতে বাধ্য করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নাগরিক। মালশিয়া বলেছে, অবৈধভাবে আসা কোনো নৌযানকে তারা উপকূলে ভিড়তে দেবে না। মানব পাচার ঠেকাতে তারা ২৪ ঘণ্টা টহলের ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সাগরে নৌযানে ভাসতে থাকা লোকগুলোকে অবিলম্বে উদ্ধার করা না হলে তারা না খেয়ে মরবে। সাগরে ভাসবে তাদের লাশ। এদিকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার হওয়া লোকজন অবর্ণনীয়
দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা না হওয়ায় বিশেষ করে নারী-শিশুরা বেশি কষ্টে আছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও অন্যান্য মানবাধিকার গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী মালাক্কা প্রণালি ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় সাত থেকে আট হাজার মানুষ যন্ত্রচালিত নৌকা ও ছোট ছোট জাহাজে ভাসছে। ধরা পড়ার ভয়ে পাচারকারীরা হয়তো তাদের রেখে পালিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব নৌযানের বেশিরভাগই থাইল্যান্ড উপকূলের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল পাচারকারীরা। সেখান থেকে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো কাজের সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দেওয়া এই লোকদের।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে পাচারকারীদের ক্যাম্প ও গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর সমালোচনার মুখে থাইল্যান্ড সরকার মানব পাচার বন্ধে সাগরে কঠোর নজরদারি শুরু করে। এরপর নারী-শিশুসহ প্রায় দুই হাজার লোককে উদ্ধার করা হয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া উপকূল থেকে। এএফপি, এপি, বিবিসি ও ব্যাংকক পোস্ট।
মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বলেছে, অবৈধ অভিবাসী বহন করা নৌযান ঠেকাতে লঙ্কারি দ্বীপের কাছে সাগরে তাদের জাহাজগুলো ২৪ ঘণ্টা টহল দিচ্ছে। এ ধরনের নৌযান এলে তারা ফিরিয়ে দেবে। যদি কোনো নৌযান ডুবে যায় তাহলেই কেবল লোকজনকে উদ্ধার করা হবে। ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী বলেছে, তারা ৪০০ অভিবাসী বহন করা একটি নৌকায় জ্বালানি তেল ও লোকজনের খাবার সরবরাহ করার পর সেটিকে আন্তর্জাতিক জলসীমার দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
ব্যাংককে ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাইকমিশনার ফর রিফিউজিসের (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র ভিভিয়ান তান বলেন, মানব পাচারকারীরা হয়তো অসহায় লোকগুলোকে এখন আর থাইল্যান্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না। তারা কাজের সন্ধানে বের হওয়া লোকগুলোকে জিম্মি করে রেখেছে অথবা পালিয়ে গেছে। এই সমস্যা সমাধানে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে হবে। এর আগে ইউএনএইচসিআর এক রিপোর্টে বলেছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ২৫ হাজার মানুষ বঙ্গোপসাগর দিয়ে পাচার হয়েছে। এ সময়ে তিনশ’র মতো লোক মারা গেছে।
এদিকে, জাতিসংঘের প্রেস ব্রিফিংয়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের পাচার প্রসঙ্গ। সোমবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ের সময় এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, জাতিসংঘ বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন করে এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি) নানা পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মানব পাচার বন্ধে কাজ করছে। অভিবাসীদের সুরক্ষা দিতে ও তাদের জীবন বাঁচাতে জাতিসংঘের পদক্ষেপের পাশাপাশি সমুদ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত সব পক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) মুখপাত্র জো লওরি বলেন, সাগরে ভাসতে থাকা লোকদের অবিলম্বে উদ্ধার করা প্রয়োজন। এ জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৎপর বেসরকারি সংস্থা আরাকান প্রজেক্টের পরিচালক ক্রিস লিওয়া বলেন, সাগরে ভাসতে থাকা লোকজন তাদের বাঁচাতে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন। মালয়েশিয়ার কাছে সাগরে ভাসমান অন্তত তিনটি নৌযান থেকে তাদের কাছে বার্তা এসেছে।
মানব পাচার ঠেকাতে জাতিসংঘের সমর্থন চায় ইইউ :ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে আসা অভিবাসীদের স্রোত ঠেকাতে বলপ্রয়োগের একটি পরিকল্পনাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতিবিষয়ক প্রধান ফেদেরিকা মোঘেরিনি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে তিনি বলেন, ইইউর প্রস্তাবটির লক্ষ্য হচ্ছে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা, যার অংশ হিসেবে তাদের নৌকাগুলোও ধ্বংস করা হবে। মোঘেরিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীদের এই সংকট অভূতপূর্ব এবং এটি ঠেকাতে ভিন্নধর্মী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ফেদেরিকা মোঘেরিনি বলেন, ইউরোপের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, সমুদ্রে এসব অভিবাসীর জীবন রক্ষা করা। তবে এখানেই ইউরোপের দায়িত্ব শেষ নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কোনো শরণার্থী কিংবা অভিবাসীকে যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠানো না হয়। মানব পাচার ঠেকাতে লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের টহলের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব কিছুদিনের মধ্যেই জাতিসংঘে উত্থাপিত হবে। তবে জাতিসংঘে লিবিয়ার নিযুক্ত প্রতিনিধি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
আরও খবর